জ্বালানি তেল খালাসে নতুন যুগে বাংলাদেশ

বিশেষ প্রতিবেদক •

গভীর সমুদ্রে ভাসমান জাহাজ থেকে সরাসরি পাইপলাইনের মাধ্যমে জ্বালানি তেল খালাসের যুগে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ।

গতকাল রবিবার রাতে মহেশখালীর গভীর সমুদ্রে নোঙর করা জাহাজ থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে পরীক্ষামূলক জ্বালানি তেল খালাস শুরু হয়। পরীক্ষা শেষ হলে আগামী আগস্ট মাস নাগাদ প্রকল্পটি আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হবে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এর আগে এসব তেল ছোট জাহাজে খালাস হতো। তাতে খরচ বেশি হতো।

প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মো. শরীফ হাসনাত জানান, সৌদি আরব থেকে আমদানি করা দেশের এ যাবৎকালের সর্ববৃহৎ অপরিশোধিত তেলের (ক্রুড অয়েল) জাহাজ ‘এমটি হোরে’ এসে পৌঁছেছে গত ২৪ জুন। গতকাল দুপুরে এই জাহাজ থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে পরীক্ষামূলক খালাসের প্রস্তুতি শুরু হয়। রাতে পাইপলাইনের মাধ্যমে কক্সবাজারের মহেশখালীর টার্মিনালে (সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং প্রকল্প—এসপিএম) সরবরাহ শুরু হয়। টার্মিনাল থেকে আবার পাইপলাইনের মাধ্যমে চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় ইস্টার্ন রিফাইনারিতে পাঠানো হবে।

মহেশখালী উপজেলার কালারমারছড়ায় ৮ হাজার ৩৪১ কোটি টাকা ব্যয়ে সরকার এসপিএম বাস্তবায়ন করছে। পরীক্ষা সফল হলে আগস্টে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্পটির উদ্বোধন করবেন বলে জানিয়েছেন প্রকৌশলী মো. শরীফ হাসনাত।

তিনি বলেন, ৮২ হাজার টন অপরিশোধিত তেল নিয়ে এমটি হোরে মহেশখালীতে মুরিং পয়েন্টের কাছে পৌঁছালে তার পরদিনই পরীক্ষামূলক খালাসের কথা ছিল। কিন্তু বৈরী আবহাওয়ার কারণে তা স্থগিত করা হয়। অবশেষে গতকাল দুপুরে পরীক্ষামূলক খালাস শুরু হয়। কোনো সমস্যা না হলে আগামী তিন দিনের মধ্যে জাহাজটির সব তেল খালাস করা হবে। পরবর্তী সময়ে তেলের জাহাজ এলে দ্বিতীয় পাইপলাইনের মাধ্যমে পরীক্ষামূলক খালাস শুরু হবে।

প্রকল্প পরিচালক বলেন, ক্রুড অয়েল নিয়ে আসা জাহাজটি মাতারবাড়ী এলাকায় সাগরে নির্মিত মুরিংয়ে যুক্ত করা এবং পাইপলাইনের মাধ্যমে তেল খালাস কার্যক্রমে সহযোগিতা করছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। পাইপলাইনে তেল খালাসের এই কার্যক্রমে বছরে ৮০০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে বলে কর্তৃপক্ষ আশা করছে। তিনি বলেন, প্রকল্পের মূল কাজের অংশ হিসেবে ১৪৬ কিলোমিটার পানির নিচে, ৭৪ কিলোমিটার ডাঙ্গায়সহ মোট ২২০ কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপনের কাজ শেষ হয়েছে।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম সোহায়েল বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় জাহাজ এমটি হোরে সৌদি আরব থেকে ক্রুড অয়েল নিয়ে এসেছে। এই জাহাজে ৮২ হাজার মেট্রিক টন ক্রুড অয়েল রয়েছে। জাহাজটি ২৩০ মিটার লম্বা এবং গভীরতা সাড়ে ১২ মিটার। জাহাজটির ৮২ হাজার মেট্রিক টন ক্রুড অয়েল সাগর থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে খালাস করা হচ্ছে, যা এর আগে কখনও হয়নি। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন এটা করেছে। এটা তাদের গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। সেই প্রকল্পে সহায়তার জন্য এই জাহাজকে সাগরে নির্মিত মুরিংয়ে পয়েন্ট আনা এবং পাইপলাইনে সংযুক্ত করতে পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের সঙ্গে কাজ করছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।

প্রকৌশলী মো. শরীফ হাসনাত জানান, কালারমারছড়ায় স্থাপন করা হয়েছে ৬০ হাজার ঘনমিটার অপরিশোধিত তেল ধারণের তিনটি এবং ৩০ হাজার ঘনমিটার ডিজেল ধারণক্ষমতার তিনটি রিজার্ভ ট্যাংক। কক্সবাজার-২ (মহেশখালী-কুতুবদিয়া) আসনের সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক বলেন, বাংলাদেশে জ্বালানির চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে উত্তেজনা চলছে। এর মধ্যে টেকসহ জ্বালানি মজুদ এবং ব্যবস্থাপনা থাকা উচিত। যার কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই প্রকল্পের উদ্যোগ নিয়েছিলেন।

সংসদ সদস্য বলেন, এত দিন গভীর সাগরে নোঙর করা বড় জাহাজ থেকে লাইটার জাহাজের মাধ্যমে জ্বালানি তেল বিশেষ করে ক্রুড অয়েল ও ডিজেল আনলোড করতে সময় লাগত ১১-১২ দিন। এতে খরচও বেশি হতো, সময়ও বেশি লাগত। এখন এসপিএম প্রকল্পের মাধ্যমে মাত্র তিন দিনের মধ্যে ক্রুড অয়েল ও ডিজেল আনলোড করা যাবে। আর দ্রুত জাহাজ ছেড়ে দেওয়া যাবে। ফলে জাহাজ ভাড়া বাঁচবে এবং খরচ কমে আসবে। এতে বছরে সরকারের বাঁচবে ৮০০ কোটি টাকা। এটা দেশের জন্য একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

পাইপলাইন যেভাবে কাজ করবে

জ্বালানি বিভাগের তথ্যমতে, কালারমারছড়া ইউনিয়ন উপকূল থেকে ছয় কিলোমিটার পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরে সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) স্থাপন করা হয়েছে। এসপিএম থেকে ৩৬ ইঞ্চি ব্যাসের দুটি আলাদা পাইপলাইনের মাধ্যমে ক্রুড অয়েল ও ডিজেল আনলোড করা হবে। ১৬ কিলোমিটার পাইপলাইন দিয়ে সেই তেল যাবে কালারমারছড়ায় পাম্প স্টেশন অ্যান্ড ট্যাংক ফার্মে। সেখান থেকে ৭৪ কিলোমিটার পাইপলাইনের মাধ্যমে তেল চলে যাবে চট্টগ্রামের আনোয়ারায় সমুদ্র উপকূলে। সেখান থেকে আবার ৩৬ কিলোমিটার পাইপলাইন দিয়ে তেল যাবে পতেঙ্গায় ইস্টার্ন রিফাইনারিতে।

যা যা হলো কালারমারছড়ায়

কালারমারছড়ার সোনারপাড়ার প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা যায়, এ প্রকল্পের শুরুতে ১৯১ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। পরে ৯০ একরে নেমে আসে। সেখানে তিনটি পরিশোধিত ও তিনটি অপরিশোধিত তেলের স্টোরেজ ট্যাংকসহ অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। স্টোরেজ ট্যাংকগুলোতে আমদানি করা তেল মজুদ রাখা হবে। প্রতিটি পরিশোধিত স্টোরেজ ট্যাংকারের ধারণক্ষমতা ৬০ হাজার ঘনমিটার ও অপরিশোধিত স্টোরেজ ট্যাংকারের ধারণক্ষমতা ৩৫ হাজার ঘনমিটার।

স্টোরেজ ট্যাংক ছাড়াও এই প্রকল্পের অভ্যন্তরে তিন ও দুই তলাবিশিষ্ট ১৮টি ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। ইলেকট্রনিক, আবাসিক, ওয়্যারহাউজ, ক্লাবঘর, ফায়ার সার্ভিস স্টেশন প্রভৃতি।

এ ছাড়া পিগিং স্টেশন, মিটারিং স্টেশন, মেইন ও বুস্টার পাম্প, জেনারেটর, সিকিউরিটি সিস্টেম ও ফায়ার ভেহিকেল, ফায়ার ওয়াটার নেটওয়ার্ক, পাম্প, ওয়াটার স্টোরেজ সুবিধাসহ ফায়ার ফাইটিং সিস্টেম রয়েছে প্রকল্পের অভ্যন্তরে।

অন্যদিকে নিরাপত্তায় ১৩টি ওয়াচ টাওয়ার, তিন তলাবিশিষ্ট দুটি গেট ও চেকপোস্ট স্থাপন করা হয়েছে। চারপাশে রয়েছে কাঁটাতারের বেষ্টনী। বর্তমানে জার্মানি ও চীনের ৫০ জন প্রকৌশলী কর্মরত রয়েছেন। শুরুর দিকে পাঁচ-ছয়শ বিদেশি নাগরিক কাজ করেন।

এসপিএম শাটডাউনের ব্যাকআপ

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) বলছে, বর্তমানে দেশে তেল রিজার্ভক্ষমতা রয়েছে সোয়া দুই মাসের। এসমপিএম প্রকল্প চালুর মধ্য দিয়ে আরও ১৫ দিনের সক্ষমতা বেড়ে আড়াই মাসে উন্নীত হবে। অন্যদিকে ১১ দিনের পরিবর্তে মাত্র ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টায় তেল খালাস করা হলে বছরে সরকারের বাঁচবে ৮০০ কোটি টাকা। এ ব্যাপারে কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকা বলেন, বিদেশ থেকে মাদার ভেসেলে আমদানি করা তেল পতেঙ্গার ডিপোতে আনলোড করতে সময় নষ্ট হয়। এখন গভীর সমুদ্রবন্দরের কাছাকাছি এসপিএম বাস্তবায়ন হচ্ছে। এটি বিরাট গুরুত্ব বহন করে। পাশাপাশি দেশের স্টোরেজ ক্যাপাসিটিও অপ্রতুল। এ প্রকল্প চালুর মাধ্যমে বৈশ্বিক সংকটে দেশে জ্বালানির যে সমস্যা হয়, এই স্টোরেজে যদি তেল রিজার্ভ তৈরি করতে পারে বাংলাদেশ, তা সংকটকালীন সময়ে বিরাট ভূমিকা রাখবে। দামের ক্ষেত্রেও সাশ্রয় হবে।

ব্যয়ের সঙ্গে বাড়ছে মেয়াদ

২০১৫ সালে নেওয়া প্রকল্পটি তিন বছরের মধ্যে শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু তিন দফা সংশোধনের মাধ্যমে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হলেও পুরোপুরি প্রস্তুত না হওয়ায় আবার মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানো হয়। আর এতে ব্যয় বেড়েছে ১ হাজার ২১৭ কোটি টাকা। প্রকল্পটির মোট ব্যয় বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ৮ হাজার ৩৪১ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ও চীন সরকারের মধ্যে জিটুজি ভিত্তিতে বাস্তবায়িত হচ্ছে এসপিএম প্রকল্প। এতে বৈদেশিক সহায়তা দিচ্ছে চায়না এক্সিম ব্যাংক। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের অধীনে ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। প্রকল্প ঠিকাদারের দায়িত্বে আছে চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি চায়না পেট্রোলিয়াম পাইপলাইন ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড (সিপিপিইসি) ইঞ্জিনিয়ারিং প্রকিউরমেন্ট অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন (ইপিসি)। এতে জার্মানিভিত্তিক আইএলএফ কনসাল্টিং ইঞ্জিনিয়ারস কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে।